ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৭ ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
Newbd24.com

খেলাপিতে এশিয়ার শীর্ষে বাংলাদেশ

  • Reporter Name
  • আপডেট সময় ০৮:৩১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • ৫ বার পড়া হয়েছে

দেশের আর্থিক খাতে সবচেয়ে বড় বোঝা এখন খেলাপি ঋণ। যে কারণে বাংলাদেশ এখন এশিয়ার সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণের দেশ বলে তথ্য দিয়েছে এডিবি। খেলাপির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে চামড়া, তৈরি পোশাক, বস্ত্র, জাহাজ নির্মাণ ও ভাঙার মতো উৎপাদনমুখী শিল্প। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, মোট খেলাপি ঋণের প্রায় অর্ধেকই উৎপাদনমুখী শিল্প খাতে। এ খাতের বহু প্রতিষ্ঠান ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে রুগ্ণ হয়ে পড়েছে। এর প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থান, ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট অনুসারে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ১৭ লাখ ১১ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০ দশমিক ২৫ শতাংশই খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। খেলাপি ঋণের স্থিতি ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। দেশের মোট কর্মসংস্থানের বড় অংশই হয়েছে উৎপাদনমুখী শিল্প খাতে। এ খাতে ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। মোট ঋণের ৪৯ দশমিক ২৮ শতাংশই এ খাতে বিতরণ করা হয়েছে। বিতরণকৃত ঋণের বিপরীতে খেলাপি ঋণের হারও সবচেয়ে বেশি এ খাতে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোট খেলাপি ঋণের ৪৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ এখন উৎপাদনমুখী শিল্প খাতে। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশের ব্যাংকগুলো কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণ লুকিয়ে রাখতে পারত। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকাও ছিল উদার। আহসান এইচ মনসুর গভর্নর হওয়ার পর খেলাপি ঋণ লুকিয়ে রাখার সংস্কৃতি অনেকটাই বন্ধ হয়েছে। এতে ব্যাংক খাতের অতীত ক্ষত স্পষ্টভাবে ফুটে উঠছে। এ বক্তব্যের সত্যতা দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া তথ্যেও। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) দেশের ব্যাংক খাতে আরো ১ লাখ ৯৪ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ২৭ শতাংশেরও বেশি এখন খেলাপির খাতায় চলে গেছে। যেখানে ২০০৯ সালে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে। এডিবি তথ্য মতে, বাংলাদেশ এখন এশিয়ার সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণের দেশ। ২০২৪ সালে দেশের মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ২ শতাংশই খেলাপি হয়ে গেছে। গত মাসে প্রকাশিত এডিবির ‘ননপারফর্মিং লোনস ওয়াচ ইন এশিয়া ২০২৫’ প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার। এটা আগের বছরের চেয়ে ২৮ শতাংশ বেশি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এশিয়ার ‘সবচেয়ে দুর্বল ব্যাংকিং ব্যবস্থার’ দেশ। এই অঞ্চলে এক বছরে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার বেড়েছে ১১ দশমিক ২ শতাংশ পয়েন্ট, যা অস্বাভাবিক। অন্যদিকে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা গত বছর বিতরণ করা ঋণের বিপরীতে খেলাপি অনুপাত কমাতে পেরেছে। নেপালে সামান্য বেড়েছে, শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার বড় অর্থনীতির দেশ ভারত তাদের খেলাপি ঋণ ৩ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে নামিয়ে ২ দশমকি ৫ শতাংশে আনতে পেরেছে, কারণ তারা বড় ধরনের ব্যাংক সংস্কার করেছে। এডিবি বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচ দেশ মিলিয়ে ২০২৩ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ৮৬ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার, যা এশিয়ার মোট খেলাপি ঋণের ১২ দশমিক ৪ শতাংশ। এই অঙ্ক আগের বছরের তুলনায় কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো চিত্র, এখানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। ২০২৩ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ১৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ২০২৩ বেড়ে হয় ৯ শতাংশ। এডিবি বলছে, এতে বোঝা যায় বাংলাদেশে ঋণ দেওয়ার নিয়মকানুন দুর্বল এবং খেলাপি ঋণ আদায়ের ব্যবস্থাও কার্যকর নয়। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বহু বছর ধরে চলা শিথিল নিয়ম, রাজনৈতিক প্রভাব ও আগের সরকারের দায় এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে। তাদের ভাষ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক আগে প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করত না। রাজনৈতিক চাপের কারণে বড় ব্যবসায়ীদের ঋণ বারবার নতুনভাবে সাজানো হতো, যেন প্রকৃত খেলাপি চিত্র বোঝা না যায়। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আগের সরকার ঋণের নিয়ম শিথিল করে রেখেছিল। বড় ব্যবসায়ীদের ঋণ বারবার পুনঃতফসিল করে দেখানো হতো, যেন সব ঠিক আছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকৃত তথ্য প্রকাশ শুরু করেছে। নিয়ম যত কড়া হবে, খেলাপি ঋণের অঙ্ক তত বাড়বে। তিনি ভারতের উদাহরণ টেনে বলেন, একসময় ভারতও খেলাপি ঋণে ডুবে ছিল। কিন্তু তারা কঠোর সংস্কার করে সমস্যা অনেক সামলেছে। সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ভারতের মতো বাংলাদেশকেও কঠোর নিয়ম প্রয়োগ করতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর কিছু পরিবর্তন এসেছে। তার মতে, এমনকি নেপালও এখন বাংলাদেশের চেয়ে ভালোভাবে ঋণ ব্যবস্থাপনা করছে। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের কাঠামোও তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী। তিনি বলেন, আগের সরকার নিয়মকানুন বদলে খেলাপি ঋণ কম দেখাত। আবার রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা প্রচুর ঋণ নিয়েছিল, যাদের মধ্যে কেউ কেউ এখন দেশ ছেড়ে পালিয়েছে বা দুর্নীতির মামলায় জড়িত। তিনি বলেন, তাদের সব ঋণ এখনো খেলাপি হিসেবে ধরা হয়নি। যদি তারা টাকা ফেরত না দেয়, তাহলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে। সেলিম রায়হান মনে করেন, শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিবর্তন নয়, বরং আইন শক্তিশালী করা, মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো এবং সবচেয়ে বড় কথা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা দরকার। আগামী নির্বাচিত সরকারকেও এই সংস্কার চালিয়ে যেতে হবে। এডিবি বলছে, এশিয়ার খেলাপি ঋণের বাজারে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু বৈশ্বিক অর্থনীতির মন্দা, বাণিজ্য দ্বন্দ্ব ও ভূরাজনৈতিক সংকট আবারও খেলাপি ঋণ বাড়িয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে যেসব দেশ বেশি ঋণনির্ভর বা বাইরের বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল তারা ঝুঁকিতে আছে। এডিবির পরামর্শ হলো, কঠোর আইন, কার্যকর বাজারব্যবস্থা ও দ্রুত নীতিগত পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি বিচারব্যবস্থা আরও দক্ষ করতে হবে, বাজার স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে ও বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তবেই এশিয়ায় খেলাপি ঋণের সমস্যা কার্যকরভাবে সামলানো যাবে।

ট্যাগস

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

খেলাপিতে এশিয়ার শীর্ষে বাংলাদেশ

আপডেট সময় ০৮:৩১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
দেশের আর্থিক খাতে সবচেয়ে বড় বোঝা এখন খেলাপি ঋণ। যে কারণে বাংলাদেশ এখন এশিয়ার সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণের দেশ বলে তথ্য দিয়েছে এডিবি। খেলাপির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে চামড়া, তৈরি পোশাক, বস্ত্র, জাহাজ নির্মাণ ও ভাঙার মতো উৎপাদনমুখী শিল্প। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, মোট খেলাপি ঋণের প্রায় অর্ধেকই উৎপাদনমুখী শিল্প খাতে। এ খাতের বহু প্রতিষ্ঠান ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে রুগ্ণ হয়ে পড়েছে। এর প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থান, ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা এবং সামগ্রিক অর্থনীতিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট অনুসারে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ১৭ লাখ ১১ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০ দশমিক ২৫ শতাংশই খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। খেলাপি ঋণের স্থিতি ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। দেশের মোট কর্মসংস্থানের বড় অংশই হয়েছে উৎপাদনমুখী শিল্প খাতে। এ খাতে ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। মোট ঋণের ৪৯ দশমিক ২৮ শতাংশই এ খাতে বিতরণ করা হয়েছে। বিতরণকৃত ঋণের বিপরীতে খেলাপি ঋণের হারও সবচেয়ে বেশি এ খাতে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোট খেলাপি ঋণের ৪৯ দশমিক ৪৩ শতাংশ এখন উৎপাদনমুখী শিল্প খাতে। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশের ব্যাংকগুলো কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণ লুকিয়ে রাখতে পারত। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকাও ছিল উদার। আহসান এইচ মনসুর গভর্নর হওয়ার পর খেলাপি ঋণ লুকিয়ে রাখার সংস্কৃতি অনেকটাই বন্ধ হয়েছে। এতে ব্যাংক খাতের অতীত ক্ষত স্পষ্টভাবে ফুটে উঠছে। এ বক্তব্যের সত্যতা দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া তথ্যেও। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) দেশের ব্যাংক খাতে আরো ১ লাখ ৯৪ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত জুন শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের ২৭ শতাংশেরও বেশি এখন খেলাপির খাতায় চলে গেছে। যেখানে ২০০৯ সালে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে। এডিবি তথ্য মতে, বাংলাদেশ এখন এশিয়ার সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণের দেশ। ২০২৪ সালে দেশের মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ২ শতাংশই খেলাপি হয়ে গেছে। গত মাসে প্রকাশিত এডিবির ‘ননপারফর্মিং লোনস ওয়াচ ইন এশিয়া ২০২৫’ প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার। এটা আগের বছরের চেয়ে ২৮ শতাংশ বেশি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এশিয়ার ‘সবচেয়ে দুর্বল ব্যাংকিং ব্যবস্থার’ দেশ। এই অঞ্চলে এক বছরে বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের হার বেড়েছে ১১ দশমিক ২ শতাংশ পয়েন্ট, যা অস্বাভাবিক। অন্যদিকে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা গত বছর বিতরণ করা ঋণের বিপরীতে খেলাপি অনুপাত কমাতে পেরেছে। নেপালে সামান্য বেড়েছে, শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার বড় অর্থনীতির দেশ ভারত তাদের খেলাপি ঋণ ৩ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে নামিয়ে ২ দশমকি ৫ শতাংশে আনতে পেরেছে, কারণ তারা বড় ধরনের ব্যাংক সংস্কার করেছে। এডিবি বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচ দেশ মিলিয়ে ২০২৩ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ৮৬ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার, যা এশিয়ার মোট খেলাপি ঋণের ১২ দশমিক ৪ শতাংশ। এই অঙ্ক আগের বছরের তুলনায় কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো চিত্র, এখানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। ২০২৩ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ১৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ২০২৩ বেড়ে হয় ৯ শতাংশ। এডিবি বলছে, এতে বোঝা যায় বাংলাদেশে ঋণ দেওয়ার নিয়মকানুন দুর্বল এবং খেলাপি ঋণ আদায়ের ব্যবস্থাও কার্যকর নয়। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বহু বছর ধরে চলা শিথিল নিয়ম, রাজনৈতিক প্রভাব ও আগের সরকারের দায় এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে। তাদের ভাষ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক আগে প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করত না। রাজনৈতিক চাপের কারণে বড় ব্যবসায়ীদের ঋণ বারবার নতুনভাবে সাজানো হতো, যেন প্রকৃত খেলাপি চিত্র বোঝা না যায়। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আগের সরকার ঋণের নিয়ম শিথিল করে রেখেছিল। বড় ব্যবসায়ীদের ঋণ বারবার পুনঃতফসিল করে দেখানো হতো, যেন সব ঠিক আছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকৃত তথ্য প্রকাশ শুরু করেছে। নিয়ম যত কড়া হবে, খেলাপি ঋণের অঙ্ক তত বাড়বে। তিনি ভারতের উদাহরণ টেনে বলেন, একসময় ভারতও খেলাপি ঋণে ডুবে ছিল। কিন্তু তারা কঠোর সংস্কার করে সমস্যা অনেক সামলেছে। সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ভারতের মতো বাংলাদেশকেও কঠোর নিয়ম প্রয়োগ করতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর দায়িত্ব নেওয়ার পর কিছু পরিবর্তন এসেছে। তার মতে, এমনকি নেপালও এখন বাংলাদেশের চেয়ে ভালোভাবে ঋণ ব্যবস্থাপনা করছে। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের কাঠামোও তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী। তিনি বলেন, আগের সরকার নিয়মকানুন বদলে খেলাপি ঋণ কম দেখাত। আবার রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা প্রচুর ঋণ নিয়েছিল, যাদের মধ্যে কেউ কেউ এখন দেশ ছেড়ে পালিয়েছে বা দুর্নীতির মামলায় জড়িত। তিনি বলেন, তাদের সব ঋণ এখনো খেলাপি হিসেবে ধরা হয়নি। যদি তারা টাকা ফেরত না দেয়, তাহলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে। সেলিম রায়হান মনে করেন, শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিবর্তন নয়, বরং আইন শক্তিশালী করা, মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো এবং সবচেয়ে বড় কথা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা দরকার। আগামী নির্বাচিত সরকারকেও এই সংস্কার চালিয়ে যেতে হবে। এডিবি বলছে, এশিয়ার খেলাপি ঋণের বাজারে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু বৈশ্বিক অর্থনীতির মন্দা, বাণিজ্য দ্বন্দ্ব ও ভূরাজনৈতিক সংকট আবারও খেলাপি ঋণ বাড়িয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে যেসব দেশ বেশি ঋণনির্ভর বা বাইরের বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল তারা ঝুঁকিতে আছে। এডিবির পরামর্শ হলো, কঠোর আইন, কার্যকর বাজারব্যবস্থা ও দ্রুত নীতিগত পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি বিচারব্যবস্থা আরও দক্ষ করতে হবে, বাজার স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে ও বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তবেই এশিয়ায় খেলাপি ঋণের সমস্যা কার্যকরভাবে সামলানো যাবে।